ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়া-মহেশখালী গভীর সমুদ্র বন্দর সংযোগ সড়কের কারণে ক্ষতির মুখে ৫০ কোটি টাকার সরকারী স্থাপনা

ইমাম খাইর, কক্সবাজার ::
মহেশখালীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্র বন্দরের সংযোগ সড়কের কারণে চকরিয়া উপজেলার বদরখালী এলাকায় বেশ কয়েকটি সরকারী অফিস ক্ষতির সম্মুখিন হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বর্তমান জরিপের আলোকে ৩০০ ফুট বিশিষ্ট সড়ক নির্মিত হলে পানি উন্নয়নবোর্ড ও সরকারী খাদ্য গোদামের অন্তত ৫০ কোটি টাকার মূল্যবান স্থাপনা ক্ষয়ক্ষতি হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনবসতি ও ফসলি জমি।
এছাড়া জরিপের অন্তর্ভুক্ত জমির মালিকেরা বর্তমান জমির বাজার মূল্যের চেয়ে এক তৃতীয়াংশের কম টাকায় তাদের সহায় সম্পত্তি ছেড়ে দেয়া থেকে রেহায় পাবে।
এদিকে বদরখালীবাসীকে বৃহৎ ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে প্রস্তাবিত এলাইনমেন্ট পরিবর্তন করে বরদখালী মৌজার দক্ষিণ পার্শ্বে পুণঃনির্ধারণের আবেদন জানিয়েছে স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (১নভেম্বর) কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে এলাকাবাসীর পক্ষে স্মারকলিপি দিয়েছেন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী, দেশের বৃহত্তম কৃষি সমিতি ‘বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতি’র সাবেক সভাপতি রশিদ আহমদ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোছাইন, সমিতির সদস্য ইবনে আদম জাহান, আকতার কামাল, নজির আহমদ, দিদারুল ইসলাম মুজিব ও আবদুল মান্নান।
স্মারকলিপি প্রদানকালে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় তারা এলাকার উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ হলে কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে, তা জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেনকে অবহিত করেন। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)এর নেতৃত্বে ৩ সদস্যের কমিটি করে দেন। সেই কমিটিকে সরেজমিন তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, সংযোগ সড়কটি বদরখালী বাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে নির্মাণের জন্য জরিপ করা হয়েছিল। স্থানীয়দের আপত্তির মুখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাজারের সর্বদক্ষিণে অথবা ৬০০ ফুট উত্তরে প্রস্তাবিত এলাইনমেন্টে জরিপ না করে বাজার থেকে মাত্র ১০০ ফুট উত্তরে করার উদ্যোগ নেয়া হয়। তাতে সরকারী খাদ্য গোদাম, পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়, কেন্দ্রীয় কবরস্থান, হেফজখানা, এতিমখানাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও বসবাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পক্ষান্তরে, বদরখালী মৌজার সর্বদক্ষিণে পানি উন্নয়নবোর্ডের বেড়িবাঁধের উপর প্রস্তাবিত সংযোগ সড়কটি করা হলে সরকারী কোন স্থাপনার ক্ষতি হবেনা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ী, ফসলি ও আবাদি জমিসহ অনেক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে এলাকাবাসী। সড়কের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার কমে আসবে। এলাইনমেন্টে ব্যক্তি মালিকানার জমি না থাকায় সরকারকে কোন ক্ষতি পূরণের টাকা দিতে হবেনা।
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায় তদানীন্তন সামন্ত-প্রভুদের রক্ষচক্ষুকে উপেক্ষা করে ব্রিটিশ আমলে ১৯২৯ সালে ভূমিহীনের সন্তানরা গড়ে তুলেছিলেন দেশের বৃহত্তম কৃষি সমিতি ‘বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতি’। এর সুনাম ও পরিচিতি দেশের গ-ি পেরিয়ে ছড়িয়ে যায়। চার হাজার একরের মতো জমি নিয়ে দুই-তিন হাজার ভূমিহীনের পরিবারের সে যাত্রার ফল হচ্ছে, কালের পরিক্রমায় ৪৫-৪৬ হাজার মানুষের ঘন বসতিপূর্ণ জনপদ বদরখালী। ২৬২ জন অংশীদার প্রতি ১২ একর জমির ভোগ-দখল নিয়ে একপ্রকার সচ্ছলতার সাথে পরিবার-পরিজনসহ সভ্যতার সোপান তৈরি ও নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জনপদের চেয়ে তারা অনেক এগিয়ে গেছেন। আধুনিক জীবনযাত্রায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১০০ বছরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিহীনের সন্তানেরা শতভাগ সফল বলা যায়।
১৯২৯ থেকে ২০১৮; ৮৯ বছরের দীর্ঘ ব্যবধানে ৪৫ হাজার মানুষের ভারে জর্জরিত বদরখালী জনপদ। প্রতি শেয়ার ১২ একর জমি নিয়ে শুরু করা পরিবারগুলোর সদস্যদের মাথাপিছু এখন ৮/৯ শতকের বেশি জমি নেই। বুকের পাঁজর দিয়ে আগলে রেখে, সন্তানের মায়ায় জমির উৎকর্ষ সাধন করেছেন তারা তিল তিল করে। জীবনযুদ্ধের লড়াকু সৈনিক হিসেবে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য ভূমিহীনের সন্তানরা এলাকায় স্থাপন করেছেন একটি ডিগ্রি কলেজ, একটি ফাজিল মাদরাসা, দু‘টি উচ্চবিদ্যালয়, ১১টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০টি জামে মসজিদ ও মক্তব, দু‘টি কওমি মাদরাসা ও চারটি কেজি স্কুল, ১ টি সরকারি হাসপাতাল, ১০টি কবরস্থান, ১০টি সাইক্লোন শেল্টারসহ মুজিবকেল্লা। বাংলাদেশ সচিবালয়ের আদলে অতি সম্প্রতি তৈরি করা, সমিতির দৃষ্টিনন্দন কার্যালয়কে ঘিরে ভূমিহীনের সন্তানেরা গড়ে তুলেছেন উপ-শহর।
এ সমিতির বুকে একাধিকবার পদার্পণ করেছেন জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে দু’বার জাতীয় সমবায় পুরস্কারগ্রহণকারী এ সমিতি সমবায় অঙ্গনের জীবন্ত মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু একাধিক বিকল্প থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য সমবায়ীর ত্যাগে গড়া উপ-শহরটি সম্প্রতি মহেশখালী গভীর সমুদ্রবন্দর সংযোগ সড়কের নিশানার শিকার। উদ্বিগ্ন সমবায়ী এবং এই সমিতির কর্মকর্তারা বদরখালীর দক্ষিণ কিংবা উত্তরে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের জমির ওপর দিয়ে প্রস্তাবিত সংযোগ সড়কটি নির্মাণের অনুরোধ করেছেন। তবে সংশ্লিষ্ট ‘জাইকার’ লোকজন তা মানতে রাজি নন। যেন পানির দরে নিয়ে নিতে চাচ্ছেন বদরখালী সমিতির সমবায়ীদের জীবনের চেয়ে মূল্যবান জমিটুকু, উপ-শহরটির বুক চিরে এবং তা দ্বিখ-িত করে। ভূমিহীনরা ধরনা দিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুয়ারে দুয়ারে।

পাঠকের মতামত: